দেশে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে প্রতি বছর জন্ম নিচ্ছে ৬ হাজার শিশু
দুই বছর বয়সী আবদুল্লাহ আফ্রাদ। থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালের বিছানায় নিশ্চুপ শুয়ে আছে, শরীরে দেয়া হচ্ছে রক্ত। ছোট্ট আফ্রাদের শরীরে প্রতি মাসে বিঁধছে একাধিক সূচের আঘাত। তবেই ভালো থাকছে এবং বেঁচে থাকছে শিশুটি। আর এই দৃশ্য খুব কাছ থেকে দেখছেন শিশুর বাবা-মা। এক বছর বয়স থেকে এই রক্ত নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
শিশুর বাবা মো. আমজাদ হোসেন ও মা সূবর্ণা ফরাজি জানান, বিয়ের আগে আমাদের কোনো চিকিৎসক এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। ভুক্তভোগী এই অভিভাবক জানান, স্কুল পর্যায়ে স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে বাহক নির্ণয় হওয়া জরুরি; তাহলে কোনো বাবা-মাকে আর সন্তানের এই কষ্টদায়ক দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে না।
১৭ বছরের তাজিমা হোসেন সিঞ্জিমার জীবনে আর দশটা কিশোরীর মতো উচ্ছলতা নেই। অন্য স্বাভাবিক কিশোরীদের চেয়ে সে অনেক দুর্বল। প্রতি মাসে অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাকে। মঙ্গলবার (৬ মে) দুপুরে হাসপাতালে বিছানায় কথা হয় সিঞ্জিনার সঙ্গে; জানান দক্ষিণের জেলা ঝিনাইদাহ থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসেন রাজধানীর থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। ঐ হাসপাতালে তাদের জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ থাকে, আরও থাকে বিনা মূল্যে থাকা, খাওয়া। রক্ত নিতে নিতে বলেন, রক্ত নেয়ার পর আয়রন জমে শরীরে সেই বাড়তি আয়রন সরানোর ওষুধ পাই বিনামূল্যে।
শুধু আফ্রাদ ও সিঞ্জিনা নয়; দেশে এমন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী আছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার। যাদের প্রতি মাসে অন্যের রক্তের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়। বাংলাদেশে এই রোগের বাহক ১১ দশমিক ৪ শতাংশ, যা প্রায় ২ কোটি। আর শুধু এই বাহকের সঙ্গে বাহকের বিয়ের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুরা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এভাবে প্রতি বছর দেশে জন্ম নিচ্ছে ৬ হাজারেরও বেশি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু। এই বিপুল সংখ্যক বাহককে সচেতন করতে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রক্ত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের রোগীর পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ২০১৮ সালে এই হাসপাতালে রোগী ছিল ২ হাজার ৭২৫ জন। ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৯৮ জন, ২০২০ সালে ৩ হাজার ৪১৬ জন, ২০২১ সালে ৪ হাজার ৯৪১ জন, ২০২২ সালে ৬ হাজার ৫৫ জন, ২০২৩ সালে ছিল ৭ হাজার ২২ জন এবং ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৫১১ জন থ্যালাসেমিয়া রোগী। প্রতি বছর ৬ থেকে ৭ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস নিয়ে যেসব ধারণা একেবারেই ঠিক নয়
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। ২০১৪-১৫ সালে বাংলাদেশে ৭ থেকে ৮ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক ছিল। বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের বরাত দিয়ে তিনি জানান, দেশে ৬০ থেকে ৭০ হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছে। একজন রোগীর পেছনে মাসে চিকিৎসা ব্যয় হয় কমপক্ষে ১৩ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দা মাসুমা রহমান বলেন, সরকারি হাসপাতালে এই রোগের চিকিৎসা নেই বললেই চলে। এই রোগীদের জন্য কিছু করার আকাঙ্ক্ষা থেকেই থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে রোগীদেরকে ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসা দেয়ার উদ্যোগ নিই ২০০২ সালে। তিনি বলেন, সচেতনতা ছাড়া কোনোভাবেই এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
এদিকে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তের রোগ। মানবকোষে রক্ত তৈরি করার জন্য দুটি জিন থাকে। কোনো ব্যক্তির রক্ত তৈরির একটি জিনে ত্রুটি থাকলে তাকে থ্যালাসেমিয়া বাহক বলে। আর দুটি জিনেই যদি ত্রুটি থাকলে তাকে থ্যালাসেমিয়া রোগী বলে। সব বাহকই রোগী হন না। শিশু জন্মের এক থেকে দুই বছরের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া রোগ ধরা পড়ে। এই রোগের লক্ষণগুলো হলো—ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, দুর্বলতা, ঘন ঘন রোগসংক্রমণ, শিশুর ওজন না বাড়া, জন্ডিস, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি।
আরও জানানো হয়, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধযোগ্য। স্বামী-স্ত্রী দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে তখনই সন্তানের এ রোগ হতে পারে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুজনের একজন যদি বাহক হন এবং অন্যজন সুস্থ হন, তাহলে কখনো এ রোগ হবে না। তাই বিয়ের আগে হবু স্বামী বা স্ত্রী থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না, তা সবারই জেনে নেয়া দরকার।
এই পরিস্থিতিতে আজ ৮ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস-২০২৫। থ্যালাসেমিয়া রোগ এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে—‘থ্যালাসেমিয়ার জন্য সামাজিক ঐক্য গড়ি, রোগীর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করি’।
>