শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় ফল এখন সাধারণ ভোক্তার জন্য বিলাসিতা
বিলাসী পণ্য হিসেবে আমদানি করা ফলের ওপর গত এক বছরে তিন দফায় ৬০ থেকে ৭০ টাকা সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে এনবিআর। বছর বছর শুল্ক বৃদ্ধির কারণে ফল এখন সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আপেল-আঙুর-কমলা হচ্ছে শিশুখাদ্য ও রোগীর পথ্য। এটা কীভাবে বিলাসী পণ্য হয়, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়।
ফলে পুষ্টি যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, ফল খাওয়া এখন সাধারণ ভোক্তার জন্য বিলাসিতা হয়ে উঠেছে। কারণ সরকার বছরের পর বছর ধরে আমদানি করা তাজা ফলের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে চলেছে। এতে একদিকে ফলের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে আমদানি ক্রমাগত কমছে।
ফল আমদানিতে ২০২১-২২ সালে শুল্ক ছিল ৮৯.৩২ শতাংশ। গত তিন বছরে তা বেড়ে এখন ১৩৬.২০ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কোনো আমদানিকারক ১০০ টাকায় এক কেজি আপেল কিনলে আমদানি শেষে ওই ফলের জন্য সরকারকে দিতে হচ্ছে ১৩৬.২০ টাকা। পরিবহন ও ব্যাংক ঋণের সুদসহ অন্যান্য খরচ যোগ করে সেই ১০০ টাকার আপেল আমদানি শেষে পাইকারি বাজারে পৌঁছাতেই খরচ পড়ছে অন্তত ২৫০ টাকা।
বছর বছর এভাবে শুল্ক-কর বৃদ্ধিতে আমদানি খরচ বেড়ে প্রভাব পড়েছে ফল আমদানিতে। চাহিদা ও বিক্রি কমে লোকসানে পড়েছে আমদানিকারকরা। একই সঙ্গে সাধারণ ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ফল। ফলের আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গত ৪ ও ৫ ফেব্রুয়ারি দেশের সব বন্দর থেকে আপেল, কমলা, মাল্টা, আঙুর, নাশপাতিসহ বিভিন্ন ফল খালাস বন্ধ রাখে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, তখন শুধু চট্টগ্রাম বন্দরে ফলবাহী কনটেনার স্তূপ হয়েছিল ১০০ কন্টেইনার। বেনাপোলসহ বিভিন্ন স্থলবন্দরে আটকে ছিল ৭৫ ট্রাক ফল। পরবর্তীতে লোকসানের ঝুঁকি থাকায় আমদানিকারকরা তা ডেলিভারি নিলেও আসন্ন রমজানে আমদানিকৃত ফল নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলের ওপর অতিরিক্ত সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) স্মারকলিপি দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন।
১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দাবি পূরণ না হলে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ফল খালাস বন্ধ রাখা হবে বলে জানান সিরাজুল। এনবিআরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আপেল, কমলা, আঙুর, নাশপাতি ও আনারসের মতো আমদানি করা ফলের ওপর মোট শুল্ক-কর ছিল ৮৯.৩২ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুল্ক-কর বাড়িয়ে ১১৩.৮০ শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরে দুই দফায় বাড়িয়ে গত ৯ জানুয়ারি তা ১৩৬.২০ শতাংশ করা হয়।
আরও পড়ুনঃ বাড়তি ভ্যাট দিতে হবে না সুপারশপে
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নূরউদ্দীন আহমেদ বলেন, বিলাসী পণ্য হিসেবে আমদানি করা ফলের ওপর গত এক বছরে তিন দফায় ৬০ থেকে ৭০ টাকা সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে এনবিআর। বছর বছর শুল্ক বৃদ্ধির কারণে ফল এখন সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আপেল-আঙুর-কমলা হচ্ছে শিশুখাদ্য ও রোগীর পথ্য। এটা কীভাবে বিলাসী পণ্য হয়, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়।
সর্বশেষ শুল্ক বৃদ্ধির মধ্যে রয়েছে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ১০ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর এবং ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্ক। তবে এসব কর পৃথকভাবে যোগ করে এই মোট শুল্ক-কর আসে না। বরং কিছু শুল্ক যেমন কাস্টমস ডিউটি, নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর প্রথমে আমদানি করা ফলের মূল্যায়নকৃত মূল্যের ওপর বসানো হয়।
নতুন এই মোট শুল্ক-করের ওপর সম্পূরক শুল্ক হিসাব করা হয়। তারপরে চূড়ান্ত পরিমাণের ওপর আরোপ করা হয় ভ্যাট ও অগ্রিম কর। এই চক্রবৃদ্ধি প্রভাব সামগ্রিক শুল্কের বোঝা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
ব্যাপক কমে গেছে ফল আমদানি ॥ আমদানি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত পাঁচ বছরে ফল আমদানি কমেছে ৭৭ হাজার ৪৭১ টন (১৮.৫৬ শতাংশ)। চট্টগ্রাম বন্দর প্লান্ট কোয়ারেন্টিন স্টেশনের তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আপেল, মাল্টা, কমলা, আঙুর, আনার, আম, ড্রাগন ফ্রুটসহ বিভিন্ন ধরনের ১ লাখ ৫৪ হাজার ৪২৬ টন ফল আমদানি করা হয়েছে এ বন্দর দিয়ে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট তাজা ফল আমদানি করা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৮৯৪ টন। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৪১০ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার ২১৩ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৩২২ টন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৩৬৫ টন তাজা ফল আমদানি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ বিশ্বের ২২টি দেশ থেকে ৩৮ ধরনের ফল আমদানি করে। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশই আপেল, মাল্টা, কমলা, আঙুর ও আনার। অন্য ৫ শতাংশ ফলের মধ্যে রয়েছে নাশপাতি, কিনুই, কৎবেল, অ্যাভোকাডো, রাম্বুটান, কিউই। ব্যবসায়ীরা বলেন, অতিরিক্ত শুল্কহারের কারণে আমদানিকৃত ফলের চাহিদা কমে যাওয়ায় অনেক আমদানিকারককে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হয়েছে। বারবার লোকসানে পড়ে গত তিন বছরে চট্টগ্রামের ফলমন্ডি থেকে অন্তত ৫০ আমদানিকারক দেউলিয়া হয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
ফলের বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের স্টেশন রোডের ফলমন্ড এলাকার ব্যবসায়ীরা জানান, শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবে গত এক সপ্তাহে মানভেদে বিভিন্ন ধরনের ফলের দাম কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে বাজারে প্রতিকেজি সাউথ আফ্রিকান রয়েল গালা আপেল বিক্রি হচ্ছে ৩৭০ থেকে ৩৮০ টাকায়। এই আপেল এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায়। অর্থাৎ কেজিতে প্রায় ১০০ টাকা বেড়েছে আপেলটির দাম।
>