সর্বশেষ ক্যান্সার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও উত্তরণের উপায় অন্বেষণ
কোন দেশে জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী প্রণয়ণ ও এর কার্যকারিতা নিরূপনের জন্য ক্যানসার নিবন্ধন অপরিহার্য।
ক্যানসার নিয়ে আমাদের নিজস্ব গ্রহণযোগ্য জাতীয় নিবন্ধন বা জরিপ নেই। ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব বা প্রকোপ বোঝার জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অব ক্যান্সার ( আইএআরসি) প্রকাশিত গ্লোবোক্যানের ওপর। এই প্রতিষ্ঠানের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ সাতষট্টি হাজার মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। বছরে এই রোগে মারা যায় প্রায় এক লাখ সতেরো হাজার মানুষ।
ক্যানসারের নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের জন্য দু’টি স্বীকৃত পদ্ধতি আছে। হাসপাতালভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন। হাসপাতালভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন পদ্ধতিতে একটি হাসপাতালে আসা রোগীদের প্রয়োজনীয় তথ্য সুসংগঠিতভাবে সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাসহ প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদন প্রশাসক, নীতিনির্ধারক ও গবেষকগণ ব্যবহার করতে পারেন। ২০০৫ সালে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে হাসপাতালভিত্তিক নিবন্ধন চালু হয়। সর্বশেষ ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবে আর্থিক বরাদ্দ না থাকায় এর আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ সম্ভব হয় নাই।
হাসপাতালভিত্তিক নিবন্ধনের সীমাবদ্ধতা হলো, এই পদ্ধতিতে একটি দেশের ক্যানসার পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র, অর্থাৎ আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার পাওয়া যায় না। একটি হাসপাতালে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগী আসে, কোন সুনির্দিষ্ট এলাকা বা জনগোষ্ঠী থেকে নয়। সে জন্য হাসপাতালে আগত রোগীর সংখ্যা জানা গেলেও কত জনসংখ্যা থেকে এই রোগীরা আক্রান্ত হয়েছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন, তা নিরূপণ করা যায় না। তাই জনগোষ্ঠীভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন প্রয়োজন।
জনগোষ্ঠীভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে কত মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত, তার তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে সংগ্রহ করা হয়। কাজটি ধারাবাহিকভাবে করতে হয়। একবার কাজটি করলে তা জরিপের পর্যায়ে পড়ে, রেজিষ্ট্রি বা নিবন্ধনের পর্যায়ে পড়ে না । হাসপাতাল ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধনের তথ্য সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি দেশের ক্যানসারের প্রকৃত তথ্য বা চিত্র পাওয়া যায়। সদ্যসমাপ্ত স্বাস্থ্যখাত কর্মসূচিতে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের কর্মপরিকল্পনায় একটি উপজেলায় জনগোষ্ঠীভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধনের প্রস্তাব ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের পরামর্শ না নিয়ে ও জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধন কর্মসূচী প্রণয়ন ও তার আওতায় না এনে একতরফাভাবে কাজটি শুরু হওয়ায় এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
প্রতিরোধ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোন দেশে কার্যকরভাবে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণের জন্য চারটি পদক্ষেপ সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিরোধ, সূচনায় বা প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয়, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা, প্রশমন সেবা। প্রতিরোধের জন্য চাই ক্যানসারের ঝুঁকি ও লক্ষণ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা, জনসাধারণকে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় উদ্বুদ্ধ করা ও কয়েকটি টীকাদান। লিভার বা যকৃতের ক্যানসারের জন্য অনেকটা দায়ী হেপাটাইটিস বি-এর টিকা এখন সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচীর (ইপিআই) শিডিউলে শিশুদের দেয়া হচ্ছে। কেউ না নিয়ে থাকলে পরিণত বয়সেও নেয়া দরকার। আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় ইপিআই এর মাধ্যমে সরকার ক্যান্সার প্রতিরোধে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজটি করেছে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেনীর শিক্ষার্থী ও স্কুলের বাইরে থাকা ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের এক ডোজ এইচপিভি (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস) টিকা বিনামূল্যে দিয়ে। জনমনে কিছু ভুল ধারণা ও অপপ্রচার থাকলেও লক্ষ্যমাত্রার শতকরা নব্বই ভাগের বেশি অর্জিত হয়েছে, যা প্রশংসার দাবী রাখে। এই কর্মসূচী অব্যাহত রাখতে হবে।
তবে, সরকারের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, বাজেট বরাদ্দ, জনবল ও ব্যবস্থাপনায়, এমনকি প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকদের মনোজগতে এখনও ক্যান্সার প্রতিরোধ বিষয়টি অবহেলিত।
সূচনায় নির্ণয়
জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের জন্য প্রায় ৫০০ ভায়া সেন্টার চালু আছে সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালে। বিএসএমএমইউ এর গাইনি বিভাগের উদ্যোগে সরকারের সহযোগিতায় পরিচালিত একটি প্রকল্পের আওতায় ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী নারীরা এখানে তাঁদের জরায়ুমুখ ও স্তনের ক্যানসার নির্ণয়ের প্রাথমিক চেকআপ করিয়ে নিতে পারছেন। তবে এই কর্মসূচী অসংগঠিত, অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ।
বর্তমানে ক্যানসারের স্ক্রিনিং হচ্ছে মূলতঃ হাসপাতালে। কেউ নিজে থেকে হাসপাতালে এলে এলে এই সেবা পায়। আবার অন্য রোগের চিকিৎসা নিতে এসেও অনেক সময় ক্যানসার শনাক্ত হয়। এটা হলো অসংগঠিত ক্যানসার স্ক্রিনিং। প্রায় বিশ বছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার পনেরো শতাংশের মতো নারীকে এর আওতায় আনা গেছে। এ জন্য সমাজভিত্তিক সংগঠিত স্ক্রিনিং কর্মসূচির বিকল্প নেই। সমাজের মানুষকে অবহিত ও উদ্বুদ্ধ করে তাদের স্ক্রিনিং সেন্টারে আনতে হবে। জাতীয়ভাবে ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি প্রণীত ও পরিচালিত থাকলে এটা করা সম্ভব হতো।
গুরুত্বপূর্ণ ও অপেক্ষাকৃত সহজ মুখগহ্বরের ক্যানসার অন্তর্ভুক্ত হয়নি বলে এটা অসম্পূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্বল্পোন্নত দেশে গণহারে তিনটি ক্যানসারের স্ক্রিনিং করা সম্ভব। এগুলো হচ্ছে স্তন ক্যানসার, জরায়ুমুখ ক্যানসার ও মুখগহ্বরের ক্যানসার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন জোর দিচ্ছে জরায়ুমুখের ক্যানসার স্ক্রিনিং এর জন্য অধিকতর কার্যকর এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট চালুর উপর। কিন্তু কম কার্যকর ভায়া টেস্ট ব্যবহৃত হচ্ছে আমাদের দেশে। কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য অনেকগুলো পিসিআর মেশিন কেনা হয়েছিলো, যেগুলি অনেকটা অব্যবহৃত পড়ে আছে অনেক হাসপাতালে। এই যন্ত্রগুলো দিয়ে এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট করা সম্ভব।
রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা
১৯৮০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি ওয়ার্ডে ক্যানসার রোগী রেখে একটি পৃথক হাসপাতাল করার উদ্যোগ শুরু হয়। এরও পরে মহাখালীতে রোটারি ক্লাব একটি ভবন তৈরি করে দেয়। সেটা রোটারি ক্যানসার ডিটেকশন ইউনিট নামে চালু হয়। ভবনটি এখনো আছে। তারই পাশে আজ গড়ে উঠেছে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। পঞ্চাশ শয্যা দিয়ে শুরু। পরে ১৫০, ৩০০ শয্যা হয়ে সম্প্রতি ৫০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতি লাখে ১০৬ জন
এর বাইরে পুরোনো সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে সীমিত আকারে ক্যানসার চিকিৎসা হয়। বেসরকারিভাবে আহ্ছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল চালু আছে। এ ছাড়া বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালে ক্যান্সার বিভাগ খোলা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা দরকার। জনসংখ্যা অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৭০টি ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকার কথা। আছে ২০টির মতো। যার অধিকাংশ ঢাকাকেন্দ্রিক। গত কয়েক দশকে ক্যানসার চিকিৎসার অগ্রগতি ও আধুনিকায়ন অবশ্যই হয়েছে। সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, দক্ষতা এসেছে সরকারি ও বেসরকারিভাবে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় আধুনিক ব্যবস্থা অপ্রতুল ও রাজধানীকেন্দ্রিক।
সারা দেশের রোগীদের রোগনির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও অনেকের আর্থিক সামর্থ্যে কুলায় না। অনেকে চিকিৎসা থেকে বিরত থাকেন। সরকার আটটি বিভাগীয় শহরে আটটি পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। দুঃখের বিষয়, ছয় বছর আগে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও ভবন নির্মাণেই ঠেকে আছে। যন্ত্রপাতি ক্রয় ও জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষে কবে মানুষ এর সেবা পাবে, তা অনিশ্চিত।
সরকারী মেডিকেল কলেজগুলিতে অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, রোগনির্ণয় ও গবেষণা বিভাগসহ ক্যান্সার কেন্দ্র চালু করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে স্ক্রিনিং, রোগনির্ণয় ও প্রাথমিক ক্যান্সার সেবা চালু করতে হবে। টেলিমেডিসিন সুবিধা যোগ করে উচ্চতর কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে দুইজন (একজন পুরুষ ও একজন নারী) চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজভিত্তিক ও সংগঠিত ক্যান্সার স্ক্রিনিং চালু করতে হবে। প্র্যোজনে এ জন্য পদ সৃষ্টি/নির্ধারিত করতে হবে।
সরকারী-বেসরকারী সমন্বিত উদ্যোগ
ক্যানসারের প্রকোপ কমাতে হলে ক্যানসার প্রতিরোধ করতে হবে। এটি প্রতিরোধের প্রধান অস্ত্র জনসচেতনতা। জনসচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে অন্য যারা কাজ করছে, তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। স্তন ক্যানসার বা জরায়ুমুখ ক্যানসার নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ আছে।
ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের বড় ভূমিকা আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের আরও বড় ভূমিকা থাকা দরকার। গণমাধ্যম এ ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছে। সিভিল সোসাইটিরও বড় ভূমিকা আছে। তবে এসব কাজের একটি সমন্বয় দরকার, সুসংগঠিত প্রচার-প্রচারণা দরকার। মানুষ সচেতন হলে ক্যানসারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ থেকে দূরে থাকবে। রোগ শনাক্তের জন্য আগেভাগে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসবে।
সরকার একা সব করতে পারবে না। সরকারী উদ্যোগের সাথে পেশাজীবি, স্বেচ্ছাসেবী ও এনজিওদের সম্পৃক্ত করতে হবে অর্থবহ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে।
পাশাপাশি লাভজনকভাবে পরিচালিত হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রের সেবা যাতে মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে, সে জন্য সরকারকে সহায়ক ভূমিকা নিতে হবে। সরকারী খাতের অপ্রতুলতা বিবেচনায় নিয়ে ‘স্ট্র্যাটেজিক পারচেজ’ এর মাধ্যমে মানসম্মত বেসরকারী সেবা স্বল্পখরচে গ্রহণের ব্যবস্থা সরকার করে দিতে পারেন। স্বাস্থ্যবীমা চালুর উদ্যোগ নিতে হবে।
নেতৃত্ব
সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজটি কেন হচ্ছে না, গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়ার পরও কেন তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। নইলে ক্যানসার প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা সমন্বিত রূপ এবং গতি পাবে না।
ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সকল পর্যায়ে যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির কারণে অযোগ্য ও অসৎ নেতৃত্ব পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে আছে। এক পুনরোজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত করতে হবে দলীয়করণ ও আমলাতান্ত্রিকতামুক্ত সকল অংশীজনগণের সমন্বয়ে।
সার্বিকভাবে একটি জাতীয় কর্মকৌশল,পরিকল্পনা ও কর্মসূচী দরকার। ২০০৮ সালে জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্র এবং ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল মেয়াদি একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল। এই দলিল তৈরিতে সহায়তা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু এরপর ওই জাতীয় কৌশলপত্র অনুসরণ সেভাবে করা হয়নি। সেটি হালনাগাদও করা হয়নি। সে অর্থে জাতীয়ভাবে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে এখন কোনো কর্মসূচি নেই।
স্বাধীনতার দীর্ঘ তেপ্পান্ন বছরে অবহেলিত ও অসম্পূর্ণ কাজগুলো ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের ফসল সংস্কারের এই অভাবিত আবহে দ্রুত শুরু হোক, নাগরিক হিসেবে এটাই সবার প্রত্যাশা।
সুপারিশ/দাবী
১. জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে আছে। একে পুনরোজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত করতে হবে দলীয়করণ ও আমলাতান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করে, সকল অংশীজনগণের সমন্বয়ে।
২. জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধন কর্মসূচী প্রণয়ন করতে হবে, যার আওতায় থাকবে প্রতি বিভাগীয় ক্যান্সার হাসপাতাল ও অন্ততঃ একটি করে উপজেলা। পাশাপাশি বেসরকারি ক্যান্সার কেন্দ্র বা সংগঠনকে উৎসাহ ও সহযোগিতা দিতে হবে এই কাজে।
৩. সরকার, পেশাজীবি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এনজিও সবাই মিলে তিনটি প্রধান ক্যান্সার (স্তন, জরায়ুমুখ, মুখগহ্বর) স্ক্রিনিং এর জন্য জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪. উপজেলা পর্যায়ে দুইজন (একজন পুরুষ ও একজন নারী) চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজভিত্তিক ও সংগঠিত ক্যান্সার স্ক্রিনিং চালু করতে হবে। প্র্যোজনে এ জন্য পদ সৃষ্টি/নির্ধারিত করতে হবে।
৫. সকল অংশীজনগণকে সম্পৃক্ত করে ক্যান্সার সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে। এজন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও মূল্যায়নের ভিত্তিতে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বাছাইকৃত বেসরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে অর্থ বরাদ্দ কিংবা প্রণোদনা দিতে হবে।
৬. সরকারী খাতে ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা সুবিধা বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্প্রসারণ করতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার দলিলে স্বাক্ষরকারী হিসেবে ক্যান্সারের মত দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল চিকিৎসার দায়িত্ব মূলতঃ সরকারের। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতা বিবেচনায় নিয়ে সরকার স্ট্র্যাটেজিক পারচেজের মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতালে স্বল্প খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে।।
৭. যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ট্যাক্স/লেভি ছাড়ের বিনিময়ে বেসরকারি হাসপাতলের ১০% সেবা দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে পাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। সরকারের এটা নিশ্চত করা উচিৎ।
৮. একজন স্বজনসহ ক্যান্সার রোগীদের যাতায়াত ভাড়া মওকুফ করা উচিৎ।
৯. দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তার অযোগ্যতা, উদ্যোগহীনতা, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতায় ক্যান্সার চিকিৎসা, নির্ণয় ও প্রতিরোধ কার্যক্রম থেকে দীর্ঘকাল জনগণ বঞ্চিত হয়, সরকারের উচিই তদম্তের মাধ্যমে দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তাহলে এ ধরণের গাফিলতি কমবে। জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে সবকয়টি রেডিওথেরাপি মেশিন অচল থাকা, জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং ও নিবন্ধন প্রোগ্রাম চালু না করার মত বিষয়গুলি তদন্তের দাবী রাখে।
অধ্যাপক ডা. মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসাকিন
প্রকল্প সমন্বয়কারী ও ক্যান্সার প্রতিরোধ বিভাগের প্রধান
গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক ক্যান্সার হাসপাতাল
সভাপতি, বাংলাদেশ ক্যান্সার ফাউন্ডেশন
সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল