মসজিদে ৩ ভাইকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় আরও একজনের মৃত্যু

মাদারীপুরে বালুর ব্যবসা নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে মসজিদের ভেতরে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাজেল হাওলাদার (১৮) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) বিকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনার পর তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে চারজনে দাঁড়ালো। এ ঘটনায় এখনও একজন আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের খোয়াজপুর-টেকেরহাট গ্রামের আজিজুল হাওলাদারের ছেলে নিহত তাজেল হাওলাদার। মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে এ তথ্য জানিয়েছেন তাজেলের বড় ভাই রাজু হাওলাদার। একই ঘটনায় এর আগে তিন ভাই নিহত হন। তারা হলেন- আতাউর রহমান সরদার ওরফে আতাবুর (৩৫), সাইফুল ইসলাম ওরফে হিটার সাইফুল (৩০) ও তাদের চাচাতো ভাই পলাশ সরদার।

তাদের মধ্যে আতাউর ও সাইফুল খোয়াজপুর ইউনিয়নের সরদার বাড়ি এলাকার আজিবর সরদারের ছেলে। সাইফুল খোয়াজপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। আর পলাশ একই এলাকার মুজাম সরদারের ছেলে। ৮ মার্চ ওই সরদার বাড়িতে হামলা ও মসজিদে কুপিয়ে জখমের ঘটনা ঘটে। তখন গুরুতর আহত হন তাজেল হাওলাদার ও অলিল সরদার (৪০)। অলিল এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় দুই ভাগে বিভক্ত ছিল জেলা আওয়ামী লীগ। একপক্ষের নেতৃত্ব দিতেন সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান এবং অপর পক্ষের নেতৃত্ব দিতেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ. ফ. ম. বাহাউদ্দিন নাছিম।

এরই জেরে জেলাজুড়ে প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ছিল দুটি গ্রুপ। দীর্ঘদিন ধরে খোয়াজপুরে কীর্তিনাশা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছিলেন নাছিম সমর্থিত খোয়াজপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। আর তার প্রতিপক্ষ হোসেন সরদার ছিলেন শাজাহান খান সমর্থিত আওয়ামী লীগ নেতা।

আরও পড়ুনঃ ২০ লাখ টাকার জাল নোটসহ ৩ জন গ্রেপ্তার

আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থাকাকালীন নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সিন্ডিকেট ও খোয়াজপুর-টেকেরহাট বাজারের ইজারা দখল নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের জেরে ২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে খোয়াজপুর বাজারে প্রকাশ্যে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হোসেন সরদারের দুই পা ভেঙে দেন সাইফুল ও তার লোকজন। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দল বদল করে স্থানীয় বিএনপি নেতা শাজাহান খান ওরফে শাজাহান মোহরির সঙ্গে যোগ দেন হোসেন সরদার। পরে পা ভাঙার প্রতিশোধ ও পুরো সিন্ডিকেট দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি।

সম্প্রতি এ নিয়ে দুই পক্ষের বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তারই জেরে ৮ মার্চ সকালে সাইফুলের বাড়িতে হামলা চালান হোসেন সরদারের লোকজন। প্রতিপক্ষের হামলা থেকে বাঁচতে সাইফুল ও তার দুই ভাই বাড়ির সামনের মসজিদে আশ্রয় নেন। হামলাকারীরা মসজিদে ঢুকে তিন ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করেন।

এ সময় তাদের উদ্ধারে এগিয়ে এলে হামলায় আহত হন তাজেল হাওলাদার ও অলিল সরদার। পরে হামলাকারীরা আতাউর ও সাইফুলের বসতঘর ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যান। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাজেল ও অলিলকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

তাজেলের বড় ভাই রাজু হাওলাদার বলেন, ‘হামলার পর আট দিন ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা শেষে ১৫ মার্চ তাজেলকে বাড়িতে আনি। মঙ্গলবার দুপুরে খাবার খাওয়ার পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে ভর্তি করার আগেই মারা যায়। বর্তমানে আমার ভাইয়ের লাশ মর্গে রাখা হয়েছে। মনে হয় রাতে লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবো না। বুধবার লাশ আমাদের কাছে দিতে পারে।’

মাদারীপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) চাতক চাকমা বলেন, ‘ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাজেল মারা গেছে বলে শুনেছি। তার লাশ এখনও ওই হাসপাতালে আছে। লাশ বাড়ি আনার পর স্বজনরা মামলা করলে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে পুলিশ জানায়, তিন ভাইকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ৮ মার্চ রাতে ৪৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৮০-৯০ জনকে আসামি করে সদর থানায় মামলা করেছেন নিহত সাইফুল ইসলামের মা সুফিয়া বেগম। মামলার প্রধান আসামিসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন- মামলার ১ নম্বর আসামি হোসেন সরদার, সুমন সরদার, ২ নম্বর আসামি মতি সরদারের স্ত্রী কুলসুম বেগম, খোয়াজপুর গ্রামের রুবেল ব্যাপারী ও সুজন মাহমুদ। ঘটনায় জড়িত বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

মাসুদুজ্জামান রাসেল