ইরানের ভয়ংকর হামলায় বিধ্বস্ত ইসরাইল
ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে এখন মহাবিপদে কট্টর ইসলামবিদ্বেষী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দেশ ইসরাইল। গাজায় মুসলিম নিধনকারী গণহত্যাকারী দেশটি এখন রীতিমতো ফিলিস্তিনের মতই জ্বলছে ইরানের মুহুর্মুহু সব ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে।
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে বেশকিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ইসরাইলের, যেখানে দেখা যায় চারিদিকে সাইরেন বাজছে আর ইসরাইলের ইহুদিরা বেশ আতঙ্কিত অবস্থায় হামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শেষমেশ তারা আশ্রয় নিয়েছে একটি হাসপাতালের বেসমেন্টে।
গাজার বাসিন্দাদের জন্য এতদিন যে চিত্র নিয়মিত ছিলো আজ তা বিপরীতমুখী হয়ে ইসরাইলের দিকেই পতিত হয়েছে। প্রকৃতির প্রতিশোধ যেনো এবার হারে হারে টের পাচ্ছেন কট্টোর ইসলামবিদ্বেষী ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
গত কয়েকদিনে ইরানের ছোড়া ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫০ জন ইসরাইলি নাগরিক, আহত হয়েছেন কয়েকশ’ মানুষ। যদিও নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য মতে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। নিহতের সংখ্যা কোনোভাবেই ৫০০-এর কম নয় আর আহতের সংখ্যাও চার হাজারের ওপরে বলে দাবি সূত্রের।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নিহত-আহতের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ পেলে বিশ্বজুড়ে ইসরাইলের যে দাপট তা মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কায় কমিয়ে দেখানো হচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ইসরাইলের বিভিন্ন শহরের সাধারণ মানুষ বেসমেন্ট ও বোম শেল্টারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। আর ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দে একটু পরপরই কেঁপে উঠছে ঘরবাড়ি।
রাজধানী তেল আবিব, হাইফা, পেতাহ তিকভা ও বাতে ইয়ামের মতো শহরগুলোতে মানুষজনকে দ্রুত বেসমেন্টে ছুটে যেতে দেখা যাচ্ছে। বিস্ফোরণের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন দৌঁড়ে নিচতলায় বা বোম শেল্টারে আশ্রয় নিচ্ছে। একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী তার সন্তানকে কোলে নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। অপর এক ভিডিওতে একটি পরিবারকে কম আলোযুক্ত বেসমেন্টে বসে থাকতে দেখা যায়, চারপাশে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
পঞ্চম এফ-৩৫ ভূপাতিত
তেহরানের প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ভারামিন শহরের কাছে একটি ইসরাইলি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে ইরান। গতকাল সকালে ভারামিন গভর্নর এই ঘোষণা দিয়েছেন। ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত যুদ্ধবিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে। ২৪ জুন (শুক্রবার) ভোরে ইসরাইল ইরানের ওপর আকস্মিক আক্রমণ শুরু করার পর এ নিয়ে পঞ্চম ইসরাইলি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করলো ইরানের সশস্ত্র বাহিনী।
হেরমেস ড্রোন ধ্বংসের প্রমাণ দিল ইরান
ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন গতকাল জানায়, ইরানের কেন্দ্রীয় ইসফাহান প্রদেশে সেনাবাহিনীর আকাশ প্রতিরক্ষা ইউনিট একটি অত্যাধুনিক হেরমেস ড্রোন ভূপাতিত করেছে। তারা ভূপাতিত ড্রোনের ভিডিও প্রকাশ করার পর বাধ্য হয়ে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীও (আইডিএফ) স্বীকার করেছে যে, তাদের একটি ড্রোন ইরানে ভূপাতিত হয়েছে।
এদিকে আইডিএফ-এর একজন মুখপাত্র বলেন, ‘একটি অভিযানের সময় বিমান বাহিনীর দূরনিয়ন্ত্রিত একটি ড্রোনকে লক্ষ্য করে সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল (ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র) ছোড়া হয়।’ ‘ড্রোনটি ইরানের আকাশসীমায় ভূপাতিত হয়েছে। এতে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি এবং এতে থাকা কোনো তথ্য ফাঁস হওয়ারও আশঙ্কা নেই,’ তিনি আরো জানান।
আরও পড়ুনঃ ইসরায়েলি হামলায় ইরানে নিহত বেড়ে ৬৩৯, আহত ১৩২০
জায়নবাদীদের সঙ্গে কখনোই আপস নয়
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, দজায়নবাদীদের সঙ্গে আপস নয়।’ অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়েছেন। মঙ্গলবার (১৭ জুন) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলে দেয়া এক পোস্টে খামেনি বলেন, ‘আমরা জায়নবাদীদের প্রতি কোনো দয়া দেখাবো না।’
ইরানের পাশে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি রাশিয়ার
ইসরাইলকে সরাসরি সামরিক সহায়তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে রাশিয়া। গতকাল রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করলে মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম আল আরাবিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলকে সরাসরি সামরিক সহায়তা দেয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে রাশিয়া। এমনকি কোনো ধরনের চিন্তা করার বিষয়েও। ইন্টারফ্যাক্স সংবাদ সংস্থা রিয়াবকভকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, রাশিয়া ইসরাইলকে এই ধরনের সহায়তা প্রদানের বিরুদ্ধে, এমনকি বিবেচনা করার বিরুদ্ধেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করছে। তিনি বলেছেন, মস্কো ইসরাইল এবং ইরান উভয়ের সাথেই যোগাযোগ রাখছে।
ইরানের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক, আইনি এবং বৈধ
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেপ এরদোগান ইরানের বিরুদ্ধে ‘উন্মাদ’ আক্রমণ চালানোর জন্য ইসরাইলের নিন্দা করে বলেছেন, এটি ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ; এর সমতুল্য। বুধবার সংসদে তার ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সদস্যদের সাথে কথা বলার সময় এ মন্তব্য করে তিনি বলেন, তুরস্ক কূটনৈতিকভাবে সংকটের সমাধান দেখতে চায় এবং আঙ্কারা গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে।
প্রতিরক্ষার সক্ষমতা ফুরিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলের
ইরান থেকে ছোড়া দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ব্যবহৃত ‘অ্যারো’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে ইসরাইলের। এমনটাই জানিয়েছে মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল (ডব্লিউজেএসজে)। চলমান সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে দেশটির প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নিয়ে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পত্রিকাটির প্রতিবেদনে এক শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয়, ওয়াশিংটন কয়েক মাস ধরেই বিষয়টি জানে এবং ইতোমধ্যে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা শক্তি জোরদার করতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়েছে।
ভূমি, নৌ ও আকাশ তিন ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। জুন থেকে সংঘর্ষ তীব্রতর হওয়ার পর পেন্টাগনও মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা উপস্থিতি বাড়িয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ সরবরাহও চাপে পড়ছে বলে জানিয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রকল্পের পরিচালক টম কারাকো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইল কেউই সারাদিন বসে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে পারে না। ইসরাইল ও তাদের মিত্রদের আরো দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, বসে থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর খেলায় থাকা যাবে না।’
পরমাণু স্থাপনা ভালো অবস্থায় আছে
ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (এইওআই) প্রধান মোহাম্মদ ইসলামি বলেছেন, দেশের পারমাণবিক স্থাপনা ভালো অবস্থায় রয়েছে। ইসরাইলি সরকারের আগ্রাসনের পর ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসলামি বুধবার আইআরআইবি’কে বলেন, পারমাণবিক স্থাপনা ভালো অবস্থায় রয়েছে। এইওআই কর্মীদের উচ্চ মনোবলের প্রশংসা করে ইরানের পারমাণবিক প্রধান বলেন, তারা তাদের শক্ত ঘাঁটিতে অবস্থান করছেন এবং অবিচলভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান সংঘাত এখন শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয় নয়, বরং এর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারেও। এই উত্তেজনার প্রেক্ষিতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে চলেছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি নতুন অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বুধবার (১৮ জুন) ষষ্ঠ দিনে গড়িয়েছে ইরান-ইসরাইল সংঘাত। একই দিন বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ২৬ সেন্ট বা ০.৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬.৭১ ডলারে। আর ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডঞও) দাম ৩৫ সেন্ট বা ০.৫ শতাংশ বেড়ে হয় ৭৫.১৯ ডলার।
এর আগে মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ দাবি করেন। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আরো যুদ্ধবিমান মোতায়েনের ঘোষণা দেয়, যাতে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রতিরক্ষা জোরদার করা যায়। সব মিলিয়ে এই ভূরাজনৈতিক চাপ বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ ও দামের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
>